বিশ্বের বাল্যবিয়েপ্রবণ শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম স্থানে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এখন ৫১ শতাংশ। যদিও বিগত বছরগুলোর তুলনায় এই হার কিছুটা কমেছে।
২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৯ শতাংশে।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশের বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ : আ প্রফাইল অব প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সচিবালয় প্রান্ত থেকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ও অন্য কর্মকর্তারা এতে যুক্ত হন। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইউনিসেফের সিনিয়র অ্যাডভাইজার ক্লডিয়া কাপ্পা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা ১৯৭০ সালের তুলনায় ৯০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, তা সত্ত্বেও এখনো এই হার অনেক বেশি। বর্তমানে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের বিয়ে হয়েছে তারা শিশু থাকা অবস্থায়ই। এটি এই দেশকে তিন কোটি ৮০ লাখ ‘শিশুকনের’ দেশে পরিণত করেছে, যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের ১৮তম জন্মদিনের আগেই। আবার এদের মধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ের শিকার শিশুদের বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের ও গ্রামে বাস করে। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অবিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। বিবাহিত প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রতি পাঁচজন ১৮ বছরের আগে ও প্রতি আটজন ২০ বছরের আগে সন্তান জন্ম দেয়। বাল্যবিয়ে কমানোর অগ্রগতি উচ্চবিত্ত ও ধনী শ্রেণির মধ্যে বেশি বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
দেশের মধ্যে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে ৯০ লাখ নারীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ জেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭৩ শতাংশ। বাল্যবিয়ে সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম জেলায়। এ জেলায় বাল্যবিয়ের হার ৩৯ শতাংশ।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে বন্ধে জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ উভয়েরই অগ্রাধিকার এটা। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশে আরো পরিবর্তন আনতে প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জাতীয় লক্ষ্য পূরণের জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধের হারে অগ্রগতি গত দশকের তুলনায় কমপক্ষে ৮ গুণ এবং এসডিজির লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৭ গুণ দ্রুততর করতে হবে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের উপপ্রতিনিধি ভিরা মেন্ডোনকা বলেন, ‘একসঙ্গে আমাদের অবশ্যই ক্ষতিকর রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে এবং বল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। মানবাধিকারের এই লঙ্ঘন ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে, যা শিশুদের কাছ থেকে তাদের শৈশব ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং নিজের পছন্দের জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগ সীমিত করে দিচ্ছে। মেয়েদের বেঁচে থাকা ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের সহিংসতা ও নিগ্রহের শিকার হওয়া কমাতে আমাদের এখনই বিনিয়োগ করতে হবে।’
চলমান কভিড-১৯ মহামারি এখন বাল্যবিয়ে বন্ধের অগ্রগতিকে আবারও পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার হুমকিতে ফেলেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শিশু এবং পরিবারগুলো যখন স্কুল বন্ধ হওয়া, আয় কমে যাওয়া এবং ঘরে বেড়ে যাওয়া চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে, তখনই বাল্যবিয়ের ঝুঁকি আরো বেড়েছে। ইউনিসেফ যে স্কুলগুলো নিরাপদে পুনরায় খোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে এটি তার অন্যতম কারণ।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও ‘মাল্টি সেক্টোরাল প্রগ্রাম টু অ্যান্ড ভায়োলেন্স অ্যাগেইন্সট উইমেন’-এর প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, “মেয়েদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে তাদের অবশ্যই পুনরায় পড়াশোনায় ফিরে যেতে উৎসাহ দিতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের পরেও পড়াশোনা করা মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘শিশুকনে’ হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে, এমনকি তারা গ্রামে বসবাসকারী এবং দরিদ্র পরিবারের সদস্য হলেও। তাই সমাজকে পরিবর্তন করতে এবং মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে শিক্ষাই আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।”
বিশ্বে পাঁচ লাখের বেশি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে : সেভ দ্য চিলড্রেন
গত ১ অক্টোবর সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিডের কারণে এ বছর বিশ্বের পাঁচ লাখেরও বেশি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ কভিডের কারণে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে পড়বে আরো ২৫ লাখ কন্যাশিশু। এটি গত ২৫ বছরে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণ এশিয়ার কন্যাশিশুরা। এ বছর এ অঞ্চলের দুই লাখেরও বেশি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে পড়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন আরো জানায়, বিশ্বের ১০ লাখেরও বেশি কন্যাশিশু এ বছরই সন্তানসম্ভাবনা হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টি ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘গ্লোবাল গার্লহুড ২০২০ : কভিড-১৯ এবং অগ্রগতি সংকটে’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে কভিড-১৯ ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইনগার অ্যাশিং বলেন, মহামারির অর্থ হলো আরো অনেক পরিবার দরিদ্র হবে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও খাদ্যাভাব এবং সহিংসতা ও নিপীড়নের ঝুঁকির মধ্যে অনেক মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সীদের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। এ বিয়েগুলো মেয়েদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে এবং বিষণ্নতাসহ নানা জটিলতার ঝুঁকি বাড়াবে।